শুক্রবার, ২৯ মার্চ ২০২৪

| ১৩ চৈত্র ১৪৩০

কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর জনক জুল ভার্ন ও তার ইতিকথা

ডেস্ক অফিস

কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর জনক জুল ভার্ন ও তার ইতিকথা

কল্পবিজ্ঞান বিষয় ভ্রমণ কাহিনী যখন বাস্তবের রূপ পরিগ্রহ করে, তখন তাকে অলৌকিক লেখক বললে বেশি বাড়িয়ে বলা হবে না। এমনই একজন লেখক ছিলেন জুল ভার্ন। উনবিংশ শতাব্দীর ফরাসি লেখক। যিনি লেখালেখিতে রীতিমত বিপ্লব ঘটিয়েছিলেন কল্পবিজ্ঞানের জগতে।

উড়োজাহাজ, রকেট কিংবা সাবমেরিনের বাস্তবিক ও ব্যবহারিক প্রয়োগের অনেক আগেই তিনি মহাকাশ ভ্রমণ ও সমুদ্রের তলদেশে ভ্রমণের কল্পকাহিনী লিখেছিলেন। পৃথিবীতে আগাথা ক্রিস্টির পরেই তার লেখা সবচেয়ে বেশি ভাষায় অনূদিত হয়েছে।

১৮৫০ থেকে ১৯০৫ সাল পর্যন্ত ৫৫ বছরের সাহিত্যজীবনে পৃথিবীবাসীকে তিনি উপহার দিয়েছেন টোয়েন্টি থাউজেন্ডস লিগস আন্ডার দ্য সি, জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ, ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন, অ্যারাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেইজ, দ্য মিস্টেরিয়াস আইল্যান্ডসহ অজস্র কল্পবিজ্ঞান কাহিনী। তিনি লেখায় এমন সব কল্পনার কথা লিখে গেছেন, যা একসময় ছিল কল্পনা, অলীক-ধাঁধা, সময়ের পরিক্রমায় সেই সব ধাঁধা এখন বাস্তব।

তাকে অনেকসময় কল্পবিজ্ঞান কাহিনীর জনক অভিহিত করা হয়। তার কল্পবিজ্ঞান কাহিনীতে বিজ্ঞানের সঙ্গে সঙ্গে ইতিহাস, রাজনীতি ও সমসাময়িক অনেক বিষয় উঠে এসেছে। তিনি পরবর্তীকালের কল্পবিজ্ঞান লেখকদের নানাভাবে প্রভাবিত করেছেন।

জুল ভার্ন ১৮২৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি ফ্রান্সের পশ্চিমে বিস্কে উপসাগরের তীরের নঁত নামের বন্দরশহরে জন্মগ্রহণ করেন। তার বাবা পিয়েরে ভার্ন ও মা সোফি অ্যালো দে লা ফুয়। শৈশবে স্থানীয় বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। ১২ বছর বয়সে জাহাজের কেবিনবয়ের কাজ নিয়ে বাড়ি থেকে পালাতে গিয়ে ধরা পড়েন মায়ের কাছে। তারপর প্রতিজ্ঞা করেন নিজের মনের মধ্যেই ঘুরে বেড়াবেন। তাই দেখা যায় সারাজীবন অ্যাডভেঞ্চারের কাহিনী লিখলেও নিজে খুব একটা ভ্রমণ করেননি। লেখক জীবনে তার পছন্দের স্থান ছিল বাড়ির চিলেকোটা।

বাবার ইচ্ছায় প্যারিসে আইনশাস্ত্র নিয়ে পড়াশুনা করেন। আইনজীবী হিসেবে কর্মজীবন শুরু করে বেশ প্রসার লাভ করেন। কিন্তু খুব দ্রুত এ পেশার প্রতি বিরক্ত হয়ে পড়েন এবং ১৮৬৭ সালে আইন ব্যবসা ছেড়ে পাড়ি জমান আমেরিকায়।

সাহিত্যাঙ্গনে তার আবির্ভাবের মঞ্চনাটক রচিয়তা হিসেবে। তার লেখা কিছু মঞ্চনাটক বেশ জনপ্রিয়তা পায়। প্রথম লেখা উপন্যাস ‘ফাইভ উইকস ইন আ বেলুন’ (১৮৬৩) অত্যন্ত অবাস্তব বলে কোনো প্রকাশক ছাপতে রাজি হননি। রেগে গিয়ে পাণ্ডুলিপি আগুনে পুড়িয়ে ফেলার সময় স্ত্রীর হস্তক্ষেপে তা রক্ষা পায়। পরে বইটি প্রকাশিত হলে রাতারাতি জনপ্রিয়তা পান। এই বইয়েরই সিক্যুয়েল আরেক জগদ্বিখ্যাত উপন্যাস ‘দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’। তার সৃষ্ট চরিত্রগুলোর মধ্যে ফিলিয়াস ফগ, ক্যাপ্টেন নিমো, রোবার ও ক্যাপ্টেন হ্যাটেরাস উল্লেখযোগ্য।

জুল ভার্নের লেখনীর সবচেয়ে আকর্ষণীয় দিক হচ্ছে তার ভবিষ্যৎ দর্শন। তিনি তার বইগুলোতে এমন কিছু বৈজ্ঞানিক যন্ত্র বা আবিষ্কারের কথা কল্পনা করেছেন, যা আজকের দিনে বর্তমান ও বাস্তব। জুল ভার্ন বিজ্ঞানী ছিলেন না, ছিলেন না কোনো ভূতত্ত্ববিদও। তিনি তার চিলেকোঠার ঘরটিতে বসে যে বইগুলো রচনা করেছেন তার মূল ইন্ধন জুগিয়েছে বিজ্ঞান ও ভূগোল সম্পর্কে তার অদম্য কৌতূহল আর তাতে রং ঢেলেছে তার ব্যতিক্রমী কল্পনাশক্তি। ‘টুয়েন্টি থাউজ্যান্ড লীগস আন্ডার দ্য সী’তে নটিলাস নামক যে ডুবোজাহাজের কল্পনা তিনি করেন, তার বাস্তব রূপ আজকের সাবমেরিন।

উড়োজাহাজ তৈরী যখন কল্পনাতীত, তখন ‘ইন টু দ্য নাইজার ব্যান্ড’ বইয়ে দেখি ‘হেলিপ্ল্যান (হেলিকপ্টার+এরোপ্ল্যান)’ যন্ত্রকে উড়তে। মরুভূমিতে পানির দেখা পাওয়া যখন নিছক আকাশকুসুম চিন্তা, তখন ‘সিটি ইন দ্য সাহারা’তে জুল ভার্ন রীতিমতো একটি শহর গড়ে তোলেন!

১৯৬৯ সালে নীল আর্মস্ট্রং চাঁদে পা রাখেন, কিন্তু তার প্রায় ১০০ বছর আগেই জুল ভার্ন কল্পনায় ‘জার্নি টু দ্য মুন’ বইয়ে পৌঁছে গিয়েছিলেন তাতে। জগদীশ চন্দ্র যখন বেতারের ধারণাও দেন নি, ‘কার্পেথিয়ান ক্যাসল’ বইয়ে জুল ভার্ন বেতারের আভাস দেন তার পাঠকদের। জুল ভার্নের কল্পনাপ্রবণ চিন্তার প্রবলতা সত্যি সেসময়ের পাঠক হলেই বোঝা যেতো ভাল করে, কারণ এখনতো এগুলো আমাদের দৈনন্দিন বাস্তব!

তার ‘টাইগার্স এন্ড ট্রেইটর্স’ উপন্যাসটি ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহ ও নানা সাহেবের ইতিহাস আশ্রিত একটি উপন্যাস, এতে অবিভক্ত ভারতবর্ষ ও বাংলাদেশের বিভিন্ন অঞ্চলের বর্ণনা পাওয়া গিয়েছে।

এ ছাড়া তার লেখা বই ‘অ্যারাউন্ড ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ (১৮৭২) অবলম্বনে নির্মিত চলচ্চিত্রের সামান্য কিছু অংশের শুটিং হয় বাংলাদেশে। তার লেখা অনেক কাহিনী ও চরিত্র নিয়ে কমিকস, চলচ্চিত্র ও নাটক নির্মিত হয়েছে।

তিনি ফরাসি ভাষায় লিখলেও বেশিরভাগ বই ইংরেজিতে অনুদিত হয়েছে। ইংরেজিতে অনুদিত উল্লেখযোগ্য বই হলোঃ ‘প্যারিস ইন দ্য টুয়েন্টিথ সেঞ্চুরি’ (১৮৬০), ‘আ জার্নি টু দ্য সেন্টার অব দ্য আর্থ’ (১৮৬৪), ‘ফ্রম দ্য আর্থ টু দ্য মুন’ (১৮৬৫), ‘টুয়েন্টি থাউজেন্ড লিগস আন্ডার দ্য সি’ (১৮৬৯), ‘দ্য মিস্টিরিয়াস আইল্যান্ড’ (১৮৭৫), ‘মাইকেল স্ট্রগফ’ (১৮৭৫), ‘দ্য আন্ডারগ্রাউন্ড সিটি’ (১৮৭৭) এবং ‘দ্য পারসেজ অব দ্য নর্থ পোল’ (১৮৮৮)। তার অনেক বইয়ের অনুবাদ বাংলাদেশের সেবা প্রকাশনী থেকে প্রকাশিত হয়েছে।

তিনি জীবদ্দশায় অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননা লাভ করেছেন। সেসবের মধ্যে উল্লেখযোগ্য হল: ফ্রান্স সাহিত্য অ্যাকাডেমির ‘অর্ডার অব মেরিট’ ও ইংল্যান্ড রয়েল একাডেমির সম্মানসূচক সদস্যপদ।

তার স্ত্রীর নাম অনরাইন হেবে দু ফ্রাইসি দ্য ভিয়ানে ভার্ন। এ দম্পতির এক সন্তান, মাইকেল ভার্ন। এ ছাড়া দুই সৎকন্যা ভ্যালেন্টাইন ও সুজানে মরেলের দেখাশোনা করতেন তিনি। কল্পবিজ্ঞানের এই ভুবনবিখ্যাত লেখক ১৯০৫ সালের ২৪ মার্চ মৃত্যুবরণ করেন।

আরএএস